Wellcome to National Portal
Text size A A A
Color C C C C

সর্ব-শেষ হাল-নাগাদ: ৪ জুন ২০২৪

ঢাকার দর্শনীয় স্থানসমূহ

​লালবাগ কেল্লা

লালবাগ কেল্লা (Lalbagh Fort) রাজধানী ঢাকার দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকায় অবস্থিত। সম্রাট আওরঙ্গজেব লালবাগ কেল্লা নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও তাঁর পুত্র যুবরাজ শাহজাদা আজম ১৬৭৮ খ্রিষ্টাব্দে লালবাগ দূর্গের নির্মাণ কাজ আরম্ভ করেন। শুরুতে লালবাগ কেল্লার নাম দেয়া হয়েছিল আওরঙ্গবাদ দূর্গ বা আওরঙ্গবাদ কেল্লা। পরবর্তীতে ১৬৮৪ খিষ্টাব্দে সুবেদার শায়েস্তা খানের কন্যা ইরান দুখত পরীবিবি মারা যাওয়ার পর তিনি দূর্গটি তৈরির কাজ বন্ধ করে দেন। ১৮৪৪ সালে আওরঙ্গবাদ এলাকাটির নাম পরিবর্তন করে লালবাগ রাখা হয়। এলাকার নামের সাথে সাথে কেল্লাটির নামও পরিবর্তিত হয়ে লালবাগ কেল্লা হিসাবে পরিচিতি লাভ করে।

বর্তমানে সুবেদার শায়েস্তা খাঁনের বাসভবন ও দরবার হল ‘লালবাগ কেল্লা জাদুঘর’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। লালবাগ কেল্লায় তিনটি ফটক থাকলেও এর মধ্যে দুইটিকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফটক দিয়ে প্রবেশের সাথে সাথে মনোরম বাগান মনকে প্রফুল্ল করে তোলে। প্রবেশ পথ ধরে সোজা এগিয়ে গেলে সামনে দেখাতে পাওয়া যায় শায়েস্তা খাঁনের কন্যা পরীবিবির স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত সমাধি সৌধ। সমাধি সৌধটি বর্গাকৃতির এবং এর প্রত্যেক বাহুর দৈর্ঘ্য ২০.২ মিটার। মার্বেল পাথরে তৈরী সমাধি সৌধটি অনন্য কারুকার্যপূর্ণ এবং মূল সমাধি সৌধের উপরের তামার পাত দিয়ে মোড়ানো একটি কৃত্রিম গম্বুজটি রয়েছে।  এছাড়াও দর্শনীয় জিনিসগুলোর মধ্যে রয়েছে লালবাগ দুর্গ মসজিদ, সুন্দর ফোয়ারা, আরো কিছু সমাধি এবং তৎকালীন সময় যুদ্ধে ব্যবহৃত কামান/তোপ।


রমনা পার্ক

রমনা পার্ক (Ramna Park) বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের প্রানকেন্দ্র রমনা এলাকায় অবস্থিত সুনিবিড় ছায়া ঘেরা পরিবেশের একটি মনোরম উদ্যান। প্রতিষ্ঠার সময় অর্থাৎ ১৬১০ সালে রমনা পার্কটি পুরানো হাইকোর্ট ভবন থেকে বর্তমান সড়ক ভবন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। রমনা পার্কের বর্তমান আয়তন ৬৮.৫০ একর। প্রতি বছর ছায়ানটের উদ্যোগে ঐতিহ্যবাহী রমনা পার্কের বটমূলে পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।

সবুজে ঢাকা মোঘল আমল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনার সাক্ষী রমনা পার্কে প্রায় ২১১ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। যার মধ্যে আছে অসংখ্য লতাগুল্ম, দুর্লভ প্রজাতির ছোট বড় বৃক্ষ এবং পাদাউক, কেয়া, কৃষ্ণচূড়া সহ নানান মৌসুমী ফুলের সমাহার। রমনা পার্কে অবস্থিত লেকের দৈর্ঘ্য ৮১২ মিটার এবং প্রস্থ ৯ থেকে ৯৪ মিটার।


আহসান মঞ্জিল

আহসান মঞ্জিল পুরান ঢাকার ইসলামপুরের কুমারটুলী এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। এটি পূর্বে ছিল ঢাকার নবাবদের আবাসিক প্রাসাদ ও জমিদারীর সদর কাচারি। বর্তমানে এটি জাদুঘর হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর প্রতিষ্ঠাতা নওয়াব আবদুল গনি।তিনি তার পুত্র খাজা আহসানুল্লাহ-র নামানুসারে এর নামকরণ করেন।১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে আহসান মঞ্জিলের নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে সমাপ্ত হয়। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে এখানে এক অনুষ্ঠিত বৈঠকে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়।  এখন এটি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর কর্তৃক পরিচালিত একটি জাদুঘর।

ইতিহাস

অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে জামালপুর পরগনার জমিদার শেখ ইনায়েতউল্লাহ আহসান মঞ্জিলের বর্তমান স্থানে রংমহল নামে একটি প্রমোদভবন তৈরি করেন। পরবর্তীতে তার পুত্র শেখ মতিউল্লাহ রংমহলটি ফরাসি বণিকদের কাছে বিক্রি করে দেন। বাণিজ্য কুঠি হিসাবে এটি দীর্ঘদিন পরিচিত ছিল। এরপরে ১৮৩০-এ বেগমবাজারে বসবাসকারী নওয়াব আবদুল গনির পিতা খাজা আলীমুল্লাহ এটি ক্রয় করে বসবাস শুরু করেন। এই বাসভবনকে কেন্দ্র করে খাজা আবদুল গনি মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানী নামক একটি ইউরোপীয় নির্মাণ ও প্রকৌশল-প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরী করান, যার প্রধান ইমারত ছিল আহসান মঞ্জিল। ১৮৫৯ সালে নওয়াব আবদুল গনি প্রাসাদটি নির্মাণ শুরু করেন যা ১৮৭২ সালে সমাপ্ত হয়। তিনি তার প্রিয় পুত্র খাজা আহসানুল্লাহর নামানুসারে এর নামকরণ করেন ‘আহসান মঞ্জিল’। ওই যুগে নবনির্মিত প্রাসাদ ভবনটি রংমহল ও পুরাতন ভবনটি অন্দরমহল নামে পরিচিত ছিল।

১৮৮৮ সালের ৭ এপ্রিল প্রবল ভূমিকম্পে পুরো আহসান মঞ্জিলের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত আহসান মঞ্জিল পুনর্নির্মাণের সময় বর্তমান উঁচু গম্বুজটি সংযোজন করা হয়। পুনর্নির্মাণ ও মেরামতের জন্য রাণীগঞ্জ থেকে উন্নতমানের ইট আনা হয়। মেরামতকর্ম পরিচালনা করেন প্রকৌশলী গোবিন্দ চন্দ্র রায়। সে আমলে ঢাকা শহরে আহসান মঞ্জিলের মতো এতো জাঁকালো ভবন আর ছিল না। এর প্রাসাদোপরি গম্বুজটি শহরের অন্যতম উঁচু চূড়া হওয়ায় তা বহুদূর থেকেও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করত। রংমহলের ৩১টি কক্ষের ২৩টিতে প্রদর্শনী উপস্থাপন করা হয়েছে। ৯টি কক্ষ লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরীতে প্রাপ্ত ও মি. ফ্রিৎজকাপ কর্তৃক ১৯০৪ সালে তোলা আলোকচিত্রের সাথে মিলিয়ে সাজানো হয়েছে। আহসান মঞ্জিলের তোষাখানা ও ক্রোকারীজ কক্ষে থাকা তৈজসপত্র ও নওয়াব এস্টেটের পুরোনো অফিস এডওয়ার্ড হাউজ থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন নিদর্শন সংরক্ষণ করে প্রদর্শনীতে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া উক্ত আলোকচিত্রের সাথে মিলিয়ে বিভিন্ন আসবাবপত্র তৈরী ও সমসাময়িককালের সাদৃশ্যপূর্ণ নিদর্শনাদি ক্রয় ও সংগ্রহ করে গ্যালারীতে উপস্থাপন করা হয়েছে। আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে এ যাবৎ সংগৃহীত নিদর্শন সংখ্যা মোট ৪০৭৭টি।


বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা

রাজধানী ঢাকার মিরপুরে মনোরম প্রকৃতিক পরিবেশে বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা (Bangladesh National Zoo) অবস্থিত। জনসাধারণের বিনোদন, প্রাণি বৈচিত্র সংরক্ষণ, প্রজনন, গবেষণা এবং বন্যপ্রাণি সম্পর্কিত জ্ঞান বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে ১৯৫০ সালে ঢাকা হাইকোর্ট প্রাঙ্গনে অল্প সংখ্যক বন্যপ্রাণি নিয়ে বাংলাদেশে চিড়িয়াখানার যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীতে ১৯৬০ সালে মিরপুরে চিড়িয়াখানা স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয় এবং ১৯৭৪ সনের ২৩ জুন বর্তমান বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।

প্রায় ৭৫ হেক্টর আয়তনের বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানার মূল আকর্ষণ পৃথিবীর বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার হলেও এখানে ১৯১ প্রজাতির দেশী-বিদেশী ২১৫০ টি প্রাণী রয়েছে। এদের মধ্যে চিত্রা হরিণ, বানর, নীলগাই, সিংহ, জলহস্তি, গন্ডার, ভালুক, সিংহ, কুমির, জেব্রা, ফ্লেমিংগো, কানিবক, পানকৌড়ি ও মাছরাঙা অন্যতম। আর প্রাণি জাদুঘরে রয়েছে প্রায় ২৪০ প্রজাতির স্টাফিং করা পশুপাখি। এছাড়া বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানায় ১৩ হেক্টর জায়গা জুড়ে দুইটি লেক রয়েছে।


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার

অজানাকে জানার নেশা মানুষের চিরন্তন আগ্রহের একটি। আর সেটা যদি হয় বিনোদনের মাধ্যমে তবে তো কথাই নেই! অজানাকে জানানোর সুযোগের পাশাপাশি মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তুলতে রাজধানী ঢাকার তেজগাঁও বিজয় সরণীর মোড়ে নির্মাণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার। পূর্বে এই নভোথিয়েটারটি ভাষানী নভোথিয়েটার নামে পরিচিত ছিল।

নামের সাথে থিয়েটার যুক্ত থাকলেও বাংলাদেশের একমাত্র নভোথিয়েটারটি কোনভাবেই অন্য সকল সাধারণ মুভি থিয়েটারের মতো নয়। ২০০৪ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেয়া এই নভোথিয়েটারে আছে ৫ ডি মুভি থিয়েটার, সিমুলেটর রাইড, ৫ ডি ইণ্টেরিয়েকটিভ এডুটেইনমেণ্ট সিমুলেটর, ডিজিটাল ও সায়েন্টিফিক এক্সিবিটস গ্যালারি, বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদের প্রতিকৃতি এবং গ্রহ ও সৌরজগতের প্রতিরূপ। এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটারে ১৫০ আসনের একটি আধুনিক মিলনায়তন, ৫০ আসনযুক্ত কনফারেন্স রুম, র‍্যাম্প, হাইড্রলিক লিফট এবং ভু-গর্ভস্থ কার পার্কিং সুবিধা রয়েছে।

৫ডি থিয়েটারের ১২০ ডিগ্রী কোণের বিশাল পর্দায় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্রক্ষেপণ যন্ত্রের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয় বর্ণিল আলোকচ্ছটা, অ্যাস্ট্রোভিশন ছবি এবং স্কাইক্যান ভিডিও যা দর্শনার্থীদের এক বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রদান করে। ৩০ আসনের রাইড সিমুলেটরে চড়ে নভোথিয়েটারে রেসিং কার, অ্যাক্রোবেটিক এ্যারোপ্লেন, মনোরেল, স্পেস ক্র্যাপ্ট, প্রাচীন পিরামিডের কোস্টার এবং এয়ারক্র্যাপ্ট ফাইবারে চড়ে রোমাঞ্চিত হবার সুযোগ রয়েছে।


সোহরাওয়ার্দী উদ্যান

রাজধানী ঢাকার শাহবাগে অবস্থিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যান (Suhrawardy Udyan) বাংলাদেশের অন্যতম একটি ঐতিহাসিক স্থান। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার নিরব সাক্ষী সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অতীতে রমনা রেসকোর্স ময়দান নামে পরিচিত ছিল। এক সময় এখানে ঘোড়দৌড়ের আয়োজন করা হলেও বর্তমানে বিভিন্ন সবুজ বৃক্ষের সুশীতল ছায়াঘেরা স্থান হিসাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সর্বজন স্বীকৃত।

আরও একটি ঐতিহাসিক পটভূমির জন্য সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যান বাংলাদেশীদের কাছে জনপ্রিয়। এখানেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের সেই বিশ্বকাপানো মহাকাব্য উপস্থাপন করেন। আর ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যানে মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। স্বাধীনতার স্বারক হিসাবে এখানে তাই নির্মাণ করা হয়েছে শিখা চিরন্তন এবং স্বাধীনতা স্তম্ভের মত নান্দ্যনিক স্থাপনা।

এছাড়াও সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যানের আশেপাশে বহু ঐতিহ্যবাহী ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে। যার মধ্যে পুরানো হাইকোর্ট ভবন, তিন নেতার মাজার, বাংলা একাডেমী, পরমানবিক শক্তি কমিশন, টিএসসি, চারুকলা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ, জাতীয় কবির সমাধি, পাবলিক লাইব্রেরী, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, রমনা পার্ক, শিশু পার্ক ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।


জাতীয় বিজ্ঞান প্রযুক্তি জাদুঘর

১৯৬৫ সালের ২৬ এপ্রিল, তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ঢাকায় জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর (National Museum of Science and Technology) প্রতিষ্ঠিত করে। প্রতিষ্ঠা সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাদুঘরটি ঢাকা গণগ্রন্থাগার ভবনে স্থানান্তর করা হয় এবং পরবর্তীতে, ১৯৭০ সালের এপ্রিল মাসে এটি চামেলীবাগে স্থানান্তর করা হয়, এবং পরের বছরের মে মাসে ধানমন্ডির ১নং সড়কে স্থানান্তর করা হয়।

১৯৭২ সালে, সরকার এটিকে জাতীয় জাদুঘরের মর্যাদা প্রদান করে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে এটি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৮৭ সাল থেকে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর নিজস্ব ভবন থেকে তার কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। বর্তমানে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর রাজধানী ঢাকার আগারগাও বিএনপি বাজারে অবস্থিত।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

ঢাকার আগারগাঁওয়ে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর (Liberation War Museum) ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বস্তুর এক দুর্লভ সংগ্রহশালা। ১৯৯৬ সালের ২২ শে মার্চ বেসরকারি উদ্যোগে ঢাকার সেগুনবাগিচার একটি ভাড়া বাসায় প্রথম মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর উদ্বোধন করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই অসংখ্য মানুষের সমর্থন ও সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে বর্তমানে পনেরো হাজারেরও অধিক সংগ্রহ রয়েছে। ২০১৭ সালের ১৬ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আগারগাঁওয়ে নির্মিত নতুন ভবনে স্থানান্তর করা হয়।

প্রায় আড়াই বিঘা জমির উপর আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নতুন ভবনের গ্যালারিগুলো মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও ইতিহাসে রুপে সাজানো হয়েছে। প্রায় ২১ হাজার বর্গফুট আয়তনের চারটি গ্যালারীতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী নানা স্মারকের মধ্যে রয়েছে দেহাবশেষ, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের ব্যবহৃত সামগ্রী, আলোকচিত্র, অস্ত্র, দলিল, চিঠিপত্র। এছাড়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জাতীয় চার নেতার ব্রোঞ্জের তৈরি ম্যুরাল স্থান পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে।

 

বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘর

বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানান্য তথ্য ভাণ্ডারের নাম বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘর (Bangabandhu Military Museum)। পুর্বে এই জাদুঘরের নাম ছিলো বাংলাদেশ সামরিক জাদুঘর (Bangladesh Military Museum)।

বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘরটি বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটারের পশ্চিম পাশে ১০ একর জমিতে নির্মিত হয়েছে। যেখানে স্বাধীনতার আগে ও পরে সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন সরঞ্জামাদি উপস্থাপন করা হয়েছে। জাদুঘরটিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনীর জন্য নির্ধারিত গ্যালারিসহ ছয়টি পৃথক অংশ রয়েছে এবং প্রতিটি বাহিনীর গ্যালারিতে রয়েছে বঙ্গবন্ধু কর্নার।

সেই প্রাচীন অটোমানদের ব্যবহৃত ঢাল-তলোয়ার, যুদ্ধ জাহাজ থেকে শুরু করে নবাব সিরাজুদ্দৌলার সাথে ইংরেজদের পলাশীর যুদ্ধের ইতিহাস, ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সকল নেতৃত্ব এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সকল সংগ্রাম ও অর্জনের ইতিহাস; এইসব কিছু ফুটিয়ে তুলা হয়েছে অতি যত্নে।

বাংলাদেশের অধিকাংশ জাদুঘর দেখলে যেমনটা মনে হয়, কাচঘেরা বাক্সে গতানুগতিক উপস্থাপন, প্রচলিত এই ধারণাকে ভেঙে দিয়েছে বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘর। এখানে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার হয়েছে!

শুধু নিদর্শন নয়, জাদুঘর কমপ্লেক্সের স্থাপত্য, প্রবেশ পথে ঝরনার খেলা, বাইরের সবুজ উদ্যান সবকিছু মিলে একটি চমৎকার ভ্রমণ স্থান।


বড় কাটরা

পুরান ঢাকার চকবাজারের বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে মুঘল আমলের এক ঐতিহাসিক নিদর্শন বড় কাটরা (Bara Katra) অবস্থিত। ১৬৪১ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহজাদা শাহ সুজার নির্দেশে প্রধান স্থপতি মীর আবুল কাসেম এই স্থাপনাটি নির্মাণ করেন। আবুল কাসেমকে সে সময় ‘মীর-ই-ইমারত’ নামে আখ্যায়িত করা হত। শাহজাদা শাহ সুজার বসবাসের জন্য বড় কাটরা নির্মিত হলেও পরবর্তী সময়ে এটি মুসাফিরখানা হিসাবে ব্যবহৃত হতে থাকে।

বড় কাটরার উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দুইটি প্রবেশ পথ রয়েছে। আয়তাকার প্রাঙ্গণ ঘিরে নির্মিত বড় কাটরার কক্ষের সংখ্যা মোট বাইশটি। পূর্ব-পশ্চিম অংশের মাঝামাঝি তিনতলা সমান উচ্চতার ফটকের দুইপাশে দ্বিতল ঘরের সারি এবং দুইপ্রান্তে আটকোণা দুইটি বুরুজ রয়েছে।

কথিত আছে, শাহজাদা শাহ সুজার জন্য এই প্রাসাদটি নির্মাণের পর তাঁর পছন্দ না হওয়ার কারণে স্থপতি আবুল কাসেমকে শর্ত সাপেক্ষ্যে ব্যবহার করার জন্য দিয়ে দেন। শর্ত ছিলো যে দানকৃত ওয়াকফ ইমারতের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ কোন অবস্থাতেই ব্যবহারের জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তির কাছ থেকে কোন প্রকার ভাড়া বা অর্থ নিতে পারবে না। তাই বাইশটি দোকানির নিকট ওয়াকফ করা দোকান বড় কাটরার খরচ নির্বাহের জন্য দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ধ্বংসপ্রায় বড় কাটরা ইমারতকে সংরক্ষণ ও সংস্কারের জন্য অধিগ্রহণ করতে চাইলেও মালিকদের বাধার কারণে তা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে এটি হোসাইনিয়া আশরাফুল উলুম মাদ্রাসার তত্ত্বাবধানে রয়েছে। প্রতিদিন সকাল ৮ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত বড় কাটরা দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে।


বাহাদুর শাহ পার্ক

পুরান ঢাকার সদরঘাট এলাকার লক্ষ্মীবাজারে অবস্থিত একটি ঐতিহ্যবাহী উদ্যানের নাম বাহাদুর শাহ পার্ক (Bahadur Shah Park)। ১৮৮৫ সালের ১৭-ই ফেব্রুয়ারী স্যার সলিমুল্লাহর পুত্র খাজা হাফিজুল্লাহ স্মরণে বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের পার্কে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়।

ডিম্বাকৃতির এই পার্কটিকে ঘিরে ৭টি রাস্তা একত্রিত হয়েছে। গাছপালার ছায়াঘেরা মনোরম পরিবেশের বাহাদুর শাহ পার্কে আরও আছে নবাবজাদা খাজা হাফিজুল্লাহ স্মরণে তৈরী স্মৃতিস্তম্ভ এবং সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক নির্মিত ফোয়ারা। ১৯৫৭ সালে নবাব খান বাহাদুর পার্কটির নাম পরিবর্তন করে বাহাদুর শাহ পার্ক রাখেন।

ইতিহাস

আঠারো শতকের শেষের দিকে বাহাদুর শাহ পার্কের স্থানে আর্মেনীয়দের একটি বিলিয়ার্ড ক্লাব ছিল। স্থানীয়রা বিলিয়ার্ড বলকে আন্টা নামে ডাকত ফলে ক্লাব ঘর ও ক্লাব সংলগ্ন মাঠ আন্টাঘর এবং আন্টা ময়দান নামে পরিচিতি লাভ করে। তারপর ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর সাধারণ মানুষের মনে ভয় জাগাতে ইংরেজ শাসকেরা বিপ্লবী সিপাহিদের লাশ এনে আন্টা ময়দানের বিভিন্ন গাছের ডালে ঝুলিয়ে রেখেছিল। পরবর্তীতে ১৮৫৮ সালে রানী ভিক্টোরিয়া কতৃক ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণের ঘোষনাপত্র আন্টা ময়দানে পাঠ করা হয় এবং সে কারণে এ স্থানটি ভিক্টোরিয়া পার্ক নামে নতুন পরিচয় লাভ করে। ১৯৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের শতবার্ষিকী পালন উপলক্ষে ভিক্টোরিয়া পার্কে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে পার্কের নাম বাহাদুর শাহ পার্ক করা হয়।


শঙ্খনিধি হাউস

বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ঐতিহ্যবাহী ৩২টি ভবনের মধ্যে অন্যতম, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ৯৩টি ঐতিহাসিক নান্দনিক ভবনের তালিকার্ভুক্ত পুরান ঢাকার টিপু সুলতান রোডে অবস্থিত শতবর্ষী পুরাতন একটি ভবনের নাম শঙ্খনিধি হাউস (Songkhonidhi House)। বিংশ শতকের শুরুতে লালমোহন সাহা, ভজহরি সাহা ও গৌর নিতাই সাহা নামের বণিক ভ্রাতৃত্রয় ব্যবসায় ব্যপক উন্নতির ফলে বণিক উপাধি বর্জন করে শঙ্খনিধি অর্থাৎ শঙ্খের বাহক উপাধি গ্রহণ করেন। ১৯২০-১৯২৬ সালে তাঁরা পুরান ঢাকার টিপু সুলতান রোড থেকে ওয়ারীর র‌্যাঙ্কিন স্ট্রিটের বিভিন্ন জায়গায় বেশকিছু ভবন নির্মাণ করেন। তিন ভাইয়ের একজন লালমোহন সাহা ১৯২১ সালে শঙ্খনিধি হাউস নির্মাণ করেন।

দ্বিতল শঙ্খনিধি হাউস নির্মাণে গোথিক-ইন্ডিয়ান ও ইন্দো-সারাসিন রীতির প্রভাব দেখা যায়। মূল ভবনের দুইপাশে ৩টি করে প্রবেশ পথ এবং উত্তর দিকে একটি মন্দির রয়েছে। শঙ্খনিধি হাউজের পূর্ব দিকে প্রায় ৫০ ফুট প্রশস্ত একতলা বিশিষ্ট স্থাপনাটি শঙ্খনিধি নাচঘর নামে পরিচিত। নাচঘরটির কারুকার্যপূর্ণ ছাড়, রঙিন টালির দেয়াল এবং প্রবেশমুখ দেখতে অনেকটা হিন্দু মন্দিরের মতো মনে হয়। দক্ষিণমুখী শঙ্খনিধি হাউজ ভবনটি সমতল হতে ৫ ফুট উঁচুতে স্থাপন করা হয়েছিল। বারান্দায় প্রবেশের জন্য ছিল ২০ ফুট প্রশস্ত সোপান। নাচঘর ছাড়াও শঙ্খনিধি হাউজের বিভিন্ন আয়তনের ৫টি ঘর রয়েছে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় শঙ্খনিধি হাউসের অধিবাসীগণ ভারতে চলে যায়। পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে শঙ্খনিধি হাউস প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকার্ভুক্ত করা হয়। ১৯৯১ সালে শঙ্খনিধি হাউসের একাংশ ও নাচঘর ভেঙে ফেলা হয়। বর্তমানে নাচঘরের স্থানে গ্র্যাজুয়েটস উচ্চ বিদ্যালয় অবস্থিত।


শহীদ বরকত স্মৃতি জাদুঘর

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের আলোকচিত্র, প্রিয়জনকে লেখা চিঠি, ভাষা শহীদদের ছবি সহ নানান ঐতিহাসিক জিনিস নিয়ে ২০১২ সালের ২৫ মার্চ ভাষা শহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালা চালু (Language Martyr Abul Barakat Memory Museum and Library) করা হয়। সবুজ ঘাসে ঢাকা শহীদ বরকত জাদুঘর (Shaheed Barkat Museum) প্রাঙ্গণে শহীদ আবুল বরকতের একটি প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়েছে।

দ্বিতল জাদুঘর ভবনের নিচতলায় শহীদ বরকতের ব্যবহৃত ঘড়ি, চিঠি, ছবি, কাপ-পিরিচ, ভাষা আন্দোলনের ডকুমেন্টারি, একুশে পদক প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে। আর দ্বিতীয় তলায় রয়েছে একটি পাঠাগার। পাঠাগারে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত পায় পাঁচশতাধিক বই সংগৃহীত আছে। আগত দর্শনার্থীদের বিভিন্ন জানা অজানা বিষয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে শহীদ বরকত স্মৃতি জাদুঘরটিতে গাইডের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এছাড়া বিশেষ দিনে এখানে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনীর আয়োজনের সুযোগ রয়েছে।

রবি থেকে বৃহস্পতি এই পাঁচদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত শহীদ বরকত স্মৃতি জাদুঘর সকল দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। আর প্রতি শুক্র ও শনিবার জাদুঘর বন্ধ থাকে।


জিঞ্জিরা প্রাসাদ

পুরান ঢাকার কেরাণীগঞ্জ উপজেলার বুড়িগঙ্গা নদীর অন্য পাড়ে অবস্থিত মোগল আমলে নির্মিত এক ঐতিহাসিক স্থাপনার নাম জিঞ্জিরা প্রাসাদ (Jinjira Prashad)। জাজিরার অপভ্রংশ জিনজিরা শব্দের অর্থ হল দ্বীপ। ১৬২০ খ্রিস্টাব্দে সুবেদার দ্বিতীয় ইব্রাহিম খাঁ প্রমোদকেন্দ্র হিসাবে জিনজিরা প্রাসাদ নির্মাণ করেন। চারপাশে পানি বেষ্টিত ভূখণ্ড বা জিনজিরার কারণে প্রাসাদটির নামকরণ জিনজিরা বা দ্বীপের প্রাসাদ। দেশীয় গাছগাছালির ছায়া ঘেরা অপূর্ব কারুকার্যখচিত জিঞ্জিরা প্রাসাদে যাওয়া আসার জন্য কাঠের পুল ব্যবহার করা হত। কথিত আছে, পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের পর সিরাজদ্দৌলার পরিবারকে জিনজিরা প্রাসাদে প্রেরণ করা হয়েছিল। স্থানীয়দের মধ্যে প্রচলিত আছে, লালবাগ কেল্লার সাথে জিঞ্জিরা প্রাসাদে যোগাযোগের জন্য বুড়িগঙ্গার তলদেশ দিয়ে একটি সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছিল, আর এ সুড়ঙ্গপথ মোগল সেনা কর্মকর্তারা ব্যবহার করতেন।

বর্তমানে বড় কাটরার আদলে নির্মিত জিঞ্জিরা প্রাসাদের প্রবেশ তোরণ ও দুইটি প্রাসাদ টিকে আছে। এক কালের নির্জন গ্রাম বা হাবেলী বর্তমানে ঘিঞ্জি বসতিতে পরিণত হয়েছে। জিঞ্জিরা প্রাসাদের চারপাশে গড়ে উঠেছে অট্টালিকা ও দোকানপাট।


বায়তুল মোকাররম মসজিদ

ঢাকার প্রাণকেন্দ্র গুলিস্তানের খুব কাছে পল্টন এলাকায় বায়তুল মোকাররম মসজিদ (Baitul Mukarram National Mosque)-এর অবস্থান। ১৯৬০ সালের ২৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকারম নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন বাওয়ানি জুট মিলসের তৎকালীন মালিক বিশিষ্ট শিল্পপতি লতিফ বাওয়ানি ও তাঁর ভাতিজা ইয়াহিয়া বাওয়ানি। সিন্ধুর বিশিষ্ট স্থপতি এ এইচ থারানির নকশায় নির্মিত বায়তুল মোকাররম মসজিদের জন্য পল্টনে ৮.৩০ একর জমি বরাদ্দ রাখা হয়। ১৯৬২ সালে মসজিদের নির্মাণ কাজ শেষ হয়।

মসজিদের নকশায় বৈচিত্র প্রদানের উদ্দেশ্যে গম্বুজ পরিহার করে কাবা ঘরের আদলে চারকোনা কাঠামো তৈরী করা হয়েছে। ৮ তলা বিশিষ্ট বায়তুল মোকাররম মসজিদের নিচ তলায় বিভিন্ন বিপণিবিতান ও গুদামঘর রয়েছে। মসজিদের ২য় তলা থেকে ষষ্ঠ তলা নামায আদায়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। ২য় তলা থেকে খতিব নামাজ পড়িয়ে থাকেন। ৩য় তলার উত্তর পাশে নারীদের নামায আদায়ের ব্যবস্থা রয়েছে। বায়তুল মোকাররম মসজিদে একসাথে প্রায় ৩০ হাজার মুসল্লি নামায আদায় করতে পারেন। মসজিদে প্রবেশে জন্য উত্তর, দক্ষিণ এবং পূর্ব দিকে পৃথক পৃথক প্রবেশ পথ রয়েছে।

১৯৭৫ সালের ২৮ মার্চ হতে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের উপর বায়তুল মোকাররম মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ন্যস্ত রয়েছে। সৌদি সরকারের অর্থায়নে ২০০৮ সালে মসজিদ সম্প্রসারনের কাজ করা হয়। প্রতি শুক্রবার জুম্মার নামাজ আদায়ের জন্য দূরদূরান্ত হতে অসংখ্য মানুষ বায়তুল মোকাররম মসজিদে আসেন।


সাত গম্বুজ মসজিদ

রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুরে অবস্থিত সাত গম্বুজ মসজিদ (Sat Gambuj Mosque) মুঘল শাসনামলে নির্মিত একটি ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। মসজিদের ছাদে বড় ৩টি এবং চার কোণে অবস্থিত ৪টি মিনারের উপর অনুগম্বুজ সহ মোট সাতটি গম্বুজের কারণে মসজিদটি সহজেই সাত গম্বুজ মসজিদ নামে পরিচিতি লাভ করে। মোগল সুবাদার শায়েস্তা খাঁর পুত্র উমিদ খাঁ ১৬৮০ সালে এই সাত গম্বুজ মসজিদ নির্মাণ করেন। সাত গম্বুজ মসজিদের সাথে লালবাগ দুর্গ মসজিদ এবং খাজা আম্বর মসজিদের অনেক মিল লক্ষ করা যায়।

আয়তাকার সাত গম্বুজ মসজিদের নামাজ কোঠার বাইরের দিকের দৈর্ঘ্য ১৭.৬৮ এবং প্রস্থ ৮.২৩ মিটার। পশ্চিম দিকের দেয়ালে তিনটি মিহরাব এবং পূর্ব দিকে ভাঁজবিশিষ্ট তিনটি খিলানের জন্য মসজিদটিকে আরো আকর্ষণীয় মনে হয়। সাত গম্বুজ মসজিদের পূর্বে একটি সমাধি রয়েছে। ভেতর থেকে অষ্টকোণ এবং বাইরের দিকে চতুষ্কোণ বিশিষ্ট সমাধিটিকে অনেকে শায়েস্তা খাঁর মেয়ের সমাধি হিসাবে মনে করেন। বিবির মাজার খ্যাত সমাধিক্ষেত্রটি এক সময় পরিত্যক্ত থাকলেও বর্তমানে এর সংস্কার করা হয়েছে।

এছাড়া মসজিদের কাছেই আছে একটি উদ্যান এবং জামিয়া রহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা। এক কালে বুড়িগঙ্গা নদীর ধারা সাত গম্বুজ মসজিদের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হলেও বর্তমানে চারপাশে বেশকিছু ছোট বড় দালানকোঠা নির্মিত হয়েছে।


তিন নেতার মাজার

রাজধানী ঢাকার দোয়েল চত্বরের কাছে অবস্থিত তিন নেতার মাজার (Teen Netar Mazar) বাংলাদেশের স্থাপত্য শিল্পের অন্যতম নিদর্শন। বাংলাদেশের জাতীয় তিন নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমুদ্দিন এবং এ কে ফজলুল হক-এর সমাধির উপর ১৯৬৩ সালে স্থপতি মাসুদ আহমদ ও এস এ জহিরুদ্দিনের নকশায় তিন নেতার মাজার স্থাপনাটি নির্মাণ করা হয়েছে। তিন নেতার মাজারের কাছেই রয়েছে হাইকোর্ট এবং শিশু একাডেমি।

স্বাধীনতার পূর্ব সময়ে এই তিন মহান নেতাই তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তিন নেতার রাজনৈতিক চর্চার বিশেষ অবদান রয়েছে। বাংলার বাঘ খ্যাত শের-এ-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী। ফজলুল হক ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া যুক্তফ্রন্ট গঠনে তাঁর ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য।

খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। ১৯৫১ সালে তাঁকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করা হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯২৪ সালে কলকাতা পৌরসভার ডেপুটি মেয়র হন এবং খাজা নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রীসভায় তিনি শ্রমমন্ত্রী নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।


জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘর

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ছিলেন একাধারে শিক্ষাবিদ, লেখিকা, কথা সাহিত্যিক ও একাত্তরের ঘাতক দালাল বিরোধী আন্দোলনের নেত্রী। একাত্তরের স্মৃতি কথা নিয়ে তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ “একাত্তরের দিনগুলি” দেশ জুড়ে পাঠক নন্দিত। জাহানারা ইমাম ও তাঁর ছেলে শহীদ রুমির স্মৃতি সংরক্ষণে এলিফ্যান্ট রোডে নিজ বাড়ীতে গড়ে তোলা হয়েছে শহীদ জননী জাহানার ইমাম স্মৃতি জাদুঘর। তরুন প্রজন্মকে মহীয়সী নারী জাহানারা ইমামমের বিভিন্ন সংগ্রাম ও আত্নত্যাগের কথা জানানোর উদ্দ্যেশে জাহানারা ইমামের ছোট ছেলে সাইফ ইমাম জামি ২০০৭ সালে সম্পূর্ন ব্যক্তিগত উদ্যোগে জাদুঘরটি গড়ে তুলেন।

একটি বড় হল রুম ও অফিস কক্ষের সমন্বয়ে স্বল্প পরিসরে পরিপাটি করে গড়ে তোলা হয়েছে জাহানারা ইমাম জাদুঘরটি। ইমাম পরিবারের নানা স্মৃতি চিহ্ন ও ব্যবহার্য জিনিসপত্র সর্ব সাধারনের প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়েছে। জাদুঘরের এক দেয়ালে কিশোরী বয়স থেকে জীবনের শেষ পর্যন্ত শহীদ জাহানারা ইমামের মুখাবয়ের পরিবর্তিত বিভিন্ন ছবি স্থান পেয়েছে। শৈল্পিক মনের অধিকারিণী শহীদ জননীর সাহিত্য সম্ভারেরও পরিচয় পাওয়া যাবে এই জাদুঘরে।

জাহানারা ইমামের লেখা বইয়ের আলমারি দেখার পাশাপাশি মিউজিয়াম থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন বই কেনাও সুযোগ আছে। জাদুঘরের এক দেয়ালে জাহানারা ইমামের দাদা, বাবা ও নাতি সহ তিন প্রজন্মের ছবি রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য থাকা শহীদ জননীর ছেলে শফি ইমাম রুমির স্বাধীনতা অর্জনে অসামান্য অবদানের কথাও তুলে ধরা হয়েছে এই জাদুঘরে। শহীদ জননী ও রুমির আলোক চিত্রের পাশাপাশি তাদের দৈনন্দিন ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র ও আসবাপত্র, শৌখিন জিনিস, প্রাপ্ত বিভিন্ন সম্মাননা, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নথি পত্র, গন আন্দোলনের বিষয়ে নানা ছবি, পোষ্টার, বিভিন্ন বই, জাহানারা ইমাম ও রুমির লেখা বিভিন্ন চিঠি, ১৯৭১ সাল ও তাঁর পরবর্তী বিভিন্ন ডকুমেন্ট প্রদর্শিত করে রাখা আছে এখানে। এছাড়াও শহীদ রুমির নিজের মাকে নিয়ে করা বিভিন্ন উক্তি ও তাঁর বন্ধুদের রুমিকে উদ্দ্যশ্যে করে লেখা স্মৃতিচারনাও স্থান পেয়েছে এই জাদুঘরে।


নর্থব্রুক হল

১৮৭৪ সালে ভারতের গভর্নর জেনারেল জর্জ ব্যরিং নর্থব্রুকের ঢাকা সফরকে স্মরণীয় করে রাখতে মোগল স্থাপত্যরীতি ও ইউরোপীয় কারুকাজের অপূর্ব সংমিশ্রণে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ফরাশগঞ্জ এলাকায় নর্থব্রুক হল (Northbrook Hall) নির্মাণ করা হয়। শুরুতে টাউন হল হিসাবে নর্থব্রুক হল নির্মাণ করা হলেও পরবর্তীতে একে গণগ্রন্থাগারের রূপ দিয়ে সাথে জনসন হল নামে একটি ক্লাব ঘর বানানো হয়। ভবনের রং লাল হওয়ার কারণে নির্মাণের পর থেকেই স্থানীয় লোকজনের কাছে নর্থব্রুক হল লালকুঠি নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯২৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নর্থব্রুক হলে সংবর্ধনা দেয়।

এক বিঘা জমির ওপর তৈরি নর্থব্রুক হল ভবনের দুই পাশে দুইটি করে অষ্টভুজাকৃতির কারুকার্যখচিত ৪টি মিনার রয়েছে। মূল ভবনের উত্তর দিকে অবস্থিত সকল প্রবেশ দরজাগুলো অশ্বখুরাকৃতি ও অর্ধ-বৃত্তাকার। মুসলিম ঐতিহ্যের স্মারক নর্থব্রুক হলের দক্ষিণ ও উত্তর দিকের নকশায় স্বতন্ত্রতা ও বৈচিত্রতা লক্ষ করা যায়। ফলে প্রথমবার দুই দিক থেকে দেখলে এই ভবনকে দুইটি পৃথক ভবন বলে মনে হয়।


জল্লাদখানা বধ্যভূমি

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্থানি হানাদার বাহিনী অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল বাঙ্গালীরা। সেই সময় প্রায় দেড় মাস অবরুদ্ধ থাকা মিরপুরের অনেক গুলো জায়গাই পাকিস্থানিদের বর্বর অত্যাচারের করুন পরিণতি হিসেবে বধ্যভূমি হয়ে উঠেছিল। ১৯৯৯ সালে ১৫ই নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উদ্যোগে মিরপুরের বিভিন্ন জায়গা খনন করা হলে মিরপুর ১০ এ জল্লাদ খানা বধ্যভূমি আবিষ্কৃত হয়। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে তৎকালীন সরকারের স্থপতি ও কবি রবিউল হুসাইনের সার্বিক পরিকল্পনায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রচেষ্টায় তৈরি করা হয় জল্লাদখানা বধ্যভূমি স্মৃতি পাঠ। ঢাকার মিরপুর ১০ এ অবস্থিত এই বধ্যভূমি মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙ্গালীদের উপর পাকিস্থানের পৈশাচিক অত্যাচারের কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম এই জল্লাদখানা বধ্যভূমিতে নির্যাতিত অসংখ্য বাঙ্গালীদের গণকবর দেওয়া হয়েছিল।

স্বাধীনতার সময় পাম্প হাউজ হিসেবে পরিচিত মিরপুর ১০ এর এই এলাকাটিকে বধ্য ভূমি হিসেবে বেছে নিয়েছিল পাকিস্থানি বাহিনী ও দোসররা। বর্বর পাকিস্থানিরা স্বাধীনতা প্রিয় বাঙ্গালীদের তাদের ট্রেনিং প্রাপ্ত জল্লাদ দিয়ে পাম্প হাউজের কূপের সামনে শিরশ্ছেদ করে পানি ভর্তি অন্ধকার কূপে ফেলে দিত। ধারণা করা হয় এই বধ্যভূমির বড় বড় সেফটি ট্যাঙ্ক ও আসে পাশের অন্যান্য জায়গায় প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার বাঙ্গালির লাশ গুম করা হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে এই স্থান প্রথম দফায় খননের পর প্রায় তিন ট্রাক হাড়গোড় জাতীয় জাদুঘরে নেওয়া হয়েছিল। বধ্যভূমি খনন কালে ৭০ টি মাথার খুলি, ৫২৯২ টি অস্থি খন্ড, মেয়েদের শাড়ী, ফ্রক, ওড়না, অলংকার ও জুতা সহ শহীদদের ব্যবহৃত নানা জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়েছিল। বধ্যভূমি জাদুঘরে পাকিস্থানের বর্বরতার বেশ কিছু চিহ্ন ও শহীদ বাঙ্গালীদের অনেক তথ্য লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। জাদুঘরের পূর্ব পাশে শিল্পী রফিকুন নবী ও মনিরুজ্জামান এর যৌথ উদ্যোগে টেরাকোটা ইট ও লোহার সমন্বয়ে “জীবন অবিনশ্বর” ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। বধ্যভূমির পাশেই সর্ব সাধারণের দেখার জন্য রাখা হয়েছে অভিশপ্ত কূপ যার ভিতরে অসংখ্য মানুষের লাশ গুম করা হতো।


গুরুদুয়ারা নানকশাহী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কলা ভবনের কাছে অবস্থিত শিখ ধর্মের একটি উপাসনালয়ের নাম গুরুদুয়ারা নানকশাহী (Gurdwara Nanak Shahi)। প্রচলিত আছে, বাংলাদেশের বৃহত্তম এই গুরুদুয়ারার স্থানটিতে ষোড়শ শতকে শিখ ধর্মের প্রবর্তক গুরু নানক কিছু সময় অবস্থান করেছিলেন। তখন তিনি একেশ্বরবাদ এবং ভ্রাতৃত্ববোধ এবং শিখ ধর্মের বিভিন্ন অনুষ্ঠানিকতা পালন সম্পর্কে নির্দেশনা প্রদান করেছিলেন। গুরুদুয়ারা নানকশাহীর নির্মাণ কাল নিয়ে মতভেদ থাকলেও ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে গুরুদুয়ারার নির্মাণ কাজ শেষ হয়।

১৯১৫ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত শ্রীচন্দ্র জ্যোতি নামে এক শিখসাধু নানকশাহীর পুরোহিত হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৭ সালের পর থেকে প্রায় ২৫ বছর এই উপাসনালয়টি পরিত্যক্ত ছিল। পরবর্তীতে ১৯৭২ ও ১৯৮৮ সালে গুরুদুয়ারা নানকশাহীর ব্যাপক সংস্কার করা করে বারান্দা সহ বেশকিছু স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। এরপর ২০১১ সালে গুরুদুয়ারার মূল ভবনের নিকটে একটি দ্বিতল ভবন তৈরী করে অফিস কক্ষ, শিখ রিসার্চ সেন্টার ও বিদেশি দর্শনার্থীদের জন্য অতিথি কক্ষ হিসাবে ব্যবহার শুরু হয়। অতীতে গুরুদুয়ারা নানকশাহীর অধীনে অনেক সম্পত্তি থাকলেও কিন্তু বর্তমান উপাসনালয়টি সীমিত পরিসরে গড়ে উঠেছে, যা বার বার সংস্কারের এক প্রতিরূপ।


 

রায়ের বাজার শহীদ বুদ্ধিজীবি স্মৃতিসৌধ

শহীদ বুদ্ধিজীবি স্মৃতিসৌধ (Shahid Intellectual Memorial) যা রায়ের বাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ ও শহীদ বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ নামেও পরিচিত। স্মৃতি স্মারকটির অবস্থান ঢাকার মোহাম্মদপুর থানার রায়েরবাজার এলাকায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তিলগ্নে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের সহযোগীদের সহায়তায় দেশের যে-সকল শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী এবং অন্যান্যদের হত্যা করেছিল তাঁদের শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ এটি নির্মাণ করা হয়।

মুঘল আমলে তুরাগ নদীর তীরে অবস্থিত রায়ের বাজার মৃৎশিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে জনবসতি শুরু হয়। লালমাটির সহজলভ্যতা এবং নদী পথে পরিবহণ ব্যয় কম হওয়ার কারনে এই অঞ্চলের বেশীরভাগ কুমোর রায়েরবাজার বসবাস করতেন। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, মুঘল আমলে রায়ের বাজারকে ‘কুমারতলী’ নামে ডাকা হতো।

এই রায়ের বাজারের সাথে জড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের ভয়াল স্মৃতি। মুক্তিযুদ্ধে নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর রাতের আধারে সাংবাদিক, শিক্ষক, শিল্পী, চিকিৎসক, লেখক, প্রকৌশলীসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন পেশার বুদ্ধিজীবিদের ঘর থেকে তুলে নিয়ে যায়। এদের মধ্যে ছিলেন ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, শহিদুল্লাহ কায়সার, ডাঃ ফজলে রাব্বীসহ আরো অনেকে। এরপর বাংলার সূর্য্য সন্তানদের নৃশংসভাবে হত্যা করে তাঁদের লাশ রায়ের বাজারের ইটখোলায় ফেলে রাখে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর রায়েরবাজারের ইটখোলায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পচা গলা লাশের স্থুপ দৃষ্টিগোচর হয়।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিকে স্মরনীয় করে রাখতে ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ সরকার রায়েরবাজারের বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পরবর্তীতে স্থপতি ফরিদউদ্দীন আহমেদ এবং স্থপতি জামি-আল-শফি-র নকশায় ১৯৯৬ সালে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে ১৯৯৯ সালে শেষ হয়।

রায়ের বাজার বধ্যভূমি (Rayer Bazar Bodhyo Bhumi) এলাকাটির আয়তন ৩.৫১ একর। স্মৃতিসৌধের প্রধান অংশে রয়েছে ১৭.৬৮ মিটার উচ্চতা, ০.৯১ মিটার প্রস্থ এবং ১১৫.৮২ মিটার দৈর্ঘ্যের ইটের তৈরি দুই প্রান্ত ভাঙ্গা এবং বাঁকানো একটি দেয়াল। যা ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহ প্রাপ্তির ইটখোলাকে নির্দেশ করে। আর দেয়ালের ভগ্ন দুইপ্রান্ত বুদ্ধিজীবী হত্যার দুঃখ এবং শোকের গভীরতা নির্দেশ করছে। দেয়ালের দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি বর্গাকৃতির জানালা রয়েছে। জানালা দিয়ে পেছনের আকাশ দেখা যায়। আর এই জানালাটি দেয়ালের শোকের গভীরতা কমিয়ে আশার বাণী বয়ে আনে।

বাঁকা দেয়ালের সামনে রয়েছে একটি স্থির জলাধার, যেখানে পানির নিচ থেকে কালো গ্র্যানাইট পাথরের একটি স্তম্ভ উপরে উঠে এসেছে। যা মুহ্যমান শোকের প্রতীক।

চন্দ্রিমা উদ্যান

ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র সংসদ ভবন সংলগ্ন ক্রিসেন্ট লেকের পাশে চন্দ্রিমা উদ্যান (Chandrima Uddan) অবস্থিত। চন্দ্রিমা উদ্যান নামকরণ নিয়ে ভিন্ন মত প্রচলিত আছে। কেউ কেউ মনে করেন এখানে একটি বাড়ি ছিল, যার মালিকের নাম চন্দ্রিমা। আবার কারো মতে, অর্ধচন্দ্রাকৃতির ক্রিসেন্ট লেকের সাথে মিলিয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ এটির নাম রাখেন চন্দ্রিমা উদ্যান।

১৯৮১ সালের পূর্বে শেরে বাংলা নগরের এই চন্দ্রিমা উদ্যান চাষাবাদ এবং গবাদিপশুর খামারের জন্য ব্যবহার করা হত। প্রায় ৭৪ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত চন্দ্রিমা উদ্যানে আছে  ঝুলন্ত সেতু, মেমোরিয়াল হল এবং মসজিদ। এছাড়া উদ্যানের কাছে অবস্থিত ক্রিসেন্ট লেকের উপর ঝুলন্ত সেতু ও ফোয়ারা আগত দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করে। চন্দ্রিমা উদ্যান সারা বছর দর্শনার্থীদের পদভারে মুখর থেকে। আর বিশেষ দিনগুলোতে প্রিয়জনদের সাথে সময় কাটাতে সকল বয়সী মানুষের আগমণ ঘটে চন্দ্রিমা উদ্যানে।


ভাষা আন্দোলন জাদুঘর

বাংলা ভাষার ইতিহাস রক্তক্ষয়ী ত্যাগের ইতিহাস। ১৯৫২ সালে সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিউর সহ নাম না জানা আরো অনেক শহীদদের রক্তের বিনিময়ে এই ভাষা অর্জিত হয়েছে। ভাষা শহীদদের স্মৃতি চির স্মরণীয় করে রাখতে ২০১০ সালে বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের দ্বিতীয় তলায় ভাষা আন্দোলন জাদুঘর (Language Movement Museum) উদ্বোধন করা হয়।

বাংলা একাডেমিতে স্থাপিত ভাষা জাদুঘরের প্রতিটি কক্ষে ভাষা আন্দোলনে শহীদদের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিস স্মৃতির স্মারক হিসাবে সংরক্ষিত আছে। সংগ্রহশালায় রয়েছে ভাষা শহীদ রফিকের ম্যাট্রিকুলেশন সার্টিফিকেট, ভাষা শহীদ শফিউর রহমানের কোট, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর কাছে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের প্রেরিত স্মারকলিপি, বাংলা ভাষায় মুদ্রিত প্রথম গ্রন্থের পৃষ্ঠা, ভাষা শহীদ শফিউর রহমানের ব্যবহৃত চটের ব্যাগ ইত্যাদি। এসব ছাড়াও ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও ঘটনাবলি সম্পর্কিত বিভিন্ন বইয়ের প্রচ্ছদ, তৎকালীন সময়ে প্রকাশিত পত্রপত্রিকার কপি এবং বিভিন্ন ঐতিহাসিক আলোকচিত্র প্রদর্শনের জন্য সংরক্ষিত আছে।


ওসমানী উদ্যান

ঢাকার গুলিস্তানে নগর ভবন ও সচিবালয়ের সংলগ্ন প্রায় ২৩.৩৭ একর জায়গাজুড়ে ওসমানী উদ্যান (Osmani Uddayan) অবস্থিত। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর নামে ওসমানি উদ্যান নামকরন ও ওসমানি অডিটোরিয়াম নির্মাণ করা হয়। ওসমানী উদ্যানের ৩টি প্রবেশ পথের প্রধান গেইটটি দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ভবনের বিপরীত পাশে অবস্থিত। গোলাপ শাহ মসজিদ এবং ওসমানি অডিটোরিয়ামের কাছে ২য় ও ৩য় প্রবেশ পথ অবস্থিত।

ওসমানী উদ্যানে প্রবেশ করতেই দিক নির্দেশক মানচিত্রে উদ্যানের লেক, হাটার পথ এবং অন্যান্য স্থাপনা সম্পর্কে ধারণা দেয়া আছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিকে সমুজ্জ্বল রাখতে মুক্তিযুদ্ধের ১১ টি সেক্টরের মত করে ওসমানী উদ্যানকেও ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছে। এবং এ মানচিত্রে সেক্টরগুলোর অবস্থান সুন্দর ভাবে লক্ষ্য করা যায়। দিক নির্দেশক মানচিত্র পেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে গেলে স্বাধীনতা স্মৃতিস্তম্ভ দেখতে পাওয়া যায়।

এছাড়াও সবুজে ঘেরা ওসমানী উদ্যানে আছে সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রধান সেনাপতি মীর জুমলার কামান, দেশি বিদেশি নানা জাতের ফুল, ফল এভং শোভাবর্ধক সহ বিভিন্ন দূর্লভ গাছের সমারোহ। আর প্রায় ৫.৩৪ একর এলাকা জুড়ে রয়েছে দুইটি লেক ও দুইটি কৃত্রিম বালু দ্বীপ।


টাকা জাদুঘর

বাংলাদেশ এবং সারাবিশ্বের অতীত ও বর্তমান মুদ্রার ইতিহাস সংরক্ষণ, মুদ্রার ঐতিহ্য ও বিকাশের ক্রমধারা সবার কাছে উপস্থাপনের লক্ষে ২০১৩ সালের ৫ই অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের প্রথম টাকা জাদুঘর (Taka Museum) প্রতিষ্ঠা করেন। রাজধানী ঢাকার মিরপুর দুই নাম্বার সেক্টরে বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেনিং একাডেমির ২য় তলায় টাকা জাদুঘরের অবস্থান। টাকা জাদুঘরের দেয়ালে সাজানো আছে রঙ-বেরঙের নকশায় সজ্জিত বৈচিত্র্যময় টাকার সংগ্রহ। প্রাচীন আমল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এই অঞ্চলে প্রচলিত প্রায় সকল ধরণের মুদ্রা দেখতে পারবেন এই জাদুঘরে। এছাড়া ডিজিটাল কিয়স্ক, ডিজিটাল সাইনেজ, এলইডি টিভি, থ্রিডি টিভি, ফোটো কিয়স্ক, প্রোজেক্টর এবং স্যুভেনির শপ স্থান পেয়েছে এই জাদুঘরে।

দুইটি গ্যালারিতে বিভক্ত জাদুঘরের প্রথম অংশে উপমহাদেশের বিভিন্ন সময়ের প্রচলিত মুদ্রা দেখতে পাবেন। দ্বিতীয় গ্যালারীতে আছে বিভিন্ন দেশের মুদ্রার সংগ্রহ। গুপ্তযুগ ও গুপ্তযুগ পরবর্তী মুদ্রা, হরিকেল রাজ্যে প্রচলিত রৌপ্য মুদ্রা এবং প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা কড়িসহ বিভিন্ন যুগের মুদ্রার পাশাপাশি প্রথম গ্যালারির শেষ প্রান্তে ডিওরমার মাধ্যমে বাংলার মুদ্রা বিনিময় ও সঞ্চয়ের পদ্ধতি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

দ্বিতীয় গ্যালারিতে বিশ্বের প্রায় ১২০ টি দেশের প্রায় ৩ হাজার পুরাতন মুদ্রা সংগ্রহ করা হয়েছে। আর এই প্রক্রিয়া এখনো চলমান। মুদ্রার পাশাপাশি টাকা জাদুঘরে প্রাচীন মুদ্রা নির্মিত অলঙ্কার, মুদ্রা সংরক্ষণের কাঠের বাক্স, লোহার তৈরি ব্যাংক, লোহার সিন্ধুক ইত্যাদি প্রদর্শনের জন্য রাখা আছে। চাইলে এই জাদুঘরে ৫০ টাকার বিনিময়ে এক লাখ টাকার বিনিময় অযোগ্য স্মারক নোটে নিজের ছবি ছাপাতে পারবেন। টাকা জাদুঘরে প্রবেশের জন্য কোন অর্থ ব্যয় করতে হয় না।